জিরো বাউন্ডারি কবিতার চতুর্থ সংখ্যার জন্য লেখা জমা দেওয়ার লাস্ট ডেট মার্চ মাসের ১০ তারিখ। দুটো কবিতা বা কবিতা বিষয়ক লেখা নিজের এক কপি ছবি সমেত পাঠিয়ে দিন আমাদের ইমেলে-0boundarykabita17@gmail.com

কবি কুমারেশ তেওয়ারীর সাক্ষাৎকার




একটি সাক্ষাত্কার যা নিছক ব্যক্তিমানুষের বা কবি মানুষের সাক্ষাত্কার নয় । একজন কবি ও সমালোচকের চোখে একটি কনসেপ্টের অবস্থান কী , সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে রইল এই সাক্ষাত্কার ।

সিনিয়র এক কবি- কুমারেশ তেওয়ারী । তিনি আসানসোলের বাসিন্দা। এই কবিকে আর নতুন করে চেনানোর প্রয়োজন নেই কারণ দুই কৃত্তিবাস,দেশ, কবিতা আশ্রম, কবিতা পাক্ষিক সহ পশ্চিমবঙ্গের প্রথম সারির সব পত্রিকাতেই তাঁকে দেখা যায় এবং অন্যান্য লিটলম্যাগে ও । নিরহঙ্কার এই কবি নিজেই ভাস্বর। আমরা আজ তাঁর সম্পর্কে ও জিরো বাউন্ডারি কনসেপ্ট সম্পর্কে তাঁর কিছু বক্তব্যও জানব ।


এই সিনিয়র কবির সাক্ষাত্কার নিয়েছেন এই সময়ের তরুন কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম কবি সুকান্ত ঘোষাল।যার কবিতার নিজস্বতার ছাপ কবিকে আলাদা করে রেখে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।




১/   কুমারেশ দা , আপনাকে আমরা এই সময়ের একজন উল্লেখযোগ্য কবি হিসাবে জানি।আপনার কবিতাচর্চা সম্পর্কে আমাদের একটু বলুন।

উত্তরঃ-  “আজি পূর্ণিমা, উঠিয়াছে পূর্ণ শশী নভে
               স্বর্ণপাত্র সম সে শীতল চাঁদ শোভে
               গগনমণ্ডলে।”
—হ্যাঁ এটাই ছিল আমার কবিতার জগতে প্রবেশের প্রথম কবিতাপ্রয়াসের দুটি পঙক্তি। তখন ক্লাস এইট। সুতরাং বুঝতেই পারছো কবিতা সম্পর্কে কোনো ধারণায় গড়ে ওঠেনি ওই বয়সে। আমি এখানে আমার প্রথম কবিতার পঙক্তি দুটি উল্লেখ করলাম এটা বোঝাতে কবিতার প্রতি আমার টান কিন্তু গড়ে উঠেছিল সেই কৈশরেই। অতঃপর শুরু হয় কবিতার পথে পথ চলা। যদিও কলেজের পড়া শেষ করার পর বিভিন্ন কারণে এই চর্চায় এক দীর্ঘকালীন ছেদ পড়ে যায়। আগুন অনেকটা স্থিমিত হয়ে আসে। তারপর বেশ কিছুদিন আমার প্রেমিকা কবিতার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর আবার ফিরে আসতেই হয় তার কাছে। এ যেন আর এক রেজারেকশন। তারপর তো কবিতার হাতে হাত রেখে এই যে এগিয়ে চলেছি যা মহাকালের অনিবার্য নিয়মে একদিন থেমে যাবে মৃত্যুতে।



২/   বিখ্যাত সব পত্র-পত্রিকায় আপনার কবিতা আমরা নিয়মিত পাচ্ছি। এত অসাধারণ লেখার তাগিদ কোথা থেকে পান?

উত্তরঃ- আমি অনেকের মুখেই শুনেছি কবিতা লিখতে কোনো পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন হয় না। এই যুক্তির সঙ্গে আমি একমত নই। এটা ঠিক হয়ত কবিতা লেখার জন্য বিরাট কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না। তবে বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনার একটা সম্পর্ক অবশ্যই আছে কবিতা লেখার সঙ্গে। ধরো একজন কবি তার কবিতার অনুষঙ্গ হিসেবে নিয়ে আসছেন মেটামরফোসিসের প্রসঙ্গ বা মেফিস্টোফিলিসের প্রসঙ্গ। এখন ওই কবির যদি ওই দুটি বিষয়ে পড়াশোনা না থাকে তাহলে তিনি কি সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারবেন ওই অনুষঙ্গ দুটি?
এখানে এই যে পড়াশোনার প্রসঙ্গ আনলাম তার কারণ হলো এটা বোঝাতে যে আমিও বলতে গেলে সেই কৈশর থেকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর পড়েছি বা পড়ার সুযোগ পেয়েছি। শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তকই পড়িনি। তারই ফল পাচ্ছি আজ যখন এই যে কবিতা লিখছি।একথা তো অস্বীকার করা যায় না যে বর্তমানের কবিতা কিন্তু অনেক পাল্টে গেছে। কবিতার শরীর হয়েছে বহুরৈখিক। এবং এই বহু রৈখিকতাকে কবিতায় ধরতে হলে কবিতার অনুষঙ্গ হিসেবে বিভিন্ন বিষয়কে তা সে বিজ্ঞান,ভূগোল ইতিহাস অথবা কবিতার বিভিন্ন ইজমকে কবিতায় ধরতে গেলে কবিকে তো পড়তেই হবে। আমি মনে করি বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেটুকু জ্ঞান বা চারণ সেটাই আমার ভালো কবিতা লেখার যে প্রয়াস তার অনুপ্রেরণা। আর বাকি তো কবিতাযাপনে থাকার ফল। যা হয়তো আমাকে বাধ্য করে ভালো লেখার চেষ্টা করতে।



৩/   প্রখ্যাত কবি এবং চিন্তাবিদ আফজল আলির 'জিরো বাউন্ডারি কবিতা'র কনসেপ্ট আপনি পড়েছেন?

উত্তরঃ- হ্যাঁ পড়েছি বেশ কয়েকবার। তবে একথা স্বীকার করছি এখনও হয়তো পূর্ণরূপে ধরতে পারিনি এই কনসেপ্টকে। মনে হয়েছে প্রতিষ্ঠাতা আফজল আলি যেন আরও বহু কিছু বলতে চেয়েছেন তার এই কনসেপ্টে। তাছাড়া যতবারই পড়েছি নতুন নতুন ডাইমেনশন যেন আবিস্কার করেছি এই লেখায়। তাই একে সম্পূর্ণরূপে ধরতে গেলে আরও কয়েকবারের পাঠ আমার কাছে দাবি রাখে এই লেখাটি।



৪/   বর্তমান সময়ের কিছু কবি এবং কবিতাপাঠক 'জিরো বাউন্ডারি কবিতা' নিয়ে প্রচুর আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এর কারণ কী?

উত্তরঃ- প্রথমত যে কোনো বিষয়ে মানুষের আগ্রহ কখন জেগে ওঠে, যখন তা নতুন। নতুনের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরকালীন। সে এই নতুন কে নিজের করে পেতে চায়। তার রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ উপভোগ করতে চায়। একটা জলাশয় যখন বহুদিন আবদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকে । বর্ষার জলে পুষ্ট হবার সুযোগ পায় না। তখন সেই জলাশয়ের জলে পচন ধরে। সেই জল ব্যবহারে মানুষের মধ্যে অনিহার জন্ম হয়। 
দ্বিতীয়ত “বহু ব্যবহারে জীর্ণ” বলে একটা কথা আছে। অর্থাৎ যে কোনো জিনিসের ব্যবহারে জীর্ণতা এলে তার প্রতি মানুষের আকর্ষণও কমে আসে বা মরে আসে। তখন সে চায় একই উপযোগীতা নিয়ে উঠে আসা কোনো নতুন সৃষ্টিকে। 
এখন হয়েছে কি কবিতাও তো এক বিমূর্ত শিল্প। যতগুলি ইজম আজ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাদেরও তো একটা জীর্ণতা আছে। কেননা ওই ইজমে ভর দিয়ে বহু বহু কবিতা লেখা হয়ে গেছে। এখন কবিতাও চাইছে তাকে আবার নতুন চিন্তাভাবনায় গড়ে তোলা হোক, এবং অবশ্যই কবি-পাঠকেরও একটা অবদমিত দাবি হয়তো ছিলো কবিতাকে এই জীর্ণতা থেকে কিছুটা মুক্তি দেওয়া হোক। তাই আফজল আলি যখন এই জিরো বাউণ্ডারি কনসেপ্ট আনলেন বা প্রতিষ্ঠা করলেন তখন কবি-পাঠকেরাও যেন আজ এক নতুন দিশারীর সন্ধ্যান পাচ্ছে।



৫/   আপনার হোয়াটস্ অ্যাপের প্রোফাইল ছবিতে দেখা যাচ্ছে আপনারই কাব্যগ্রন্থ 'মিরর এফেক্ট'। 
এই কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত কবিতাগুলি লিখতে আপনি কীধরনের অনুভূতি প্রয়োগ করেছেন?আর
কতগুলো কাব্যগ্রন্থ এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে?

উত্তরঃ- মিরর এফেক্ট-এর কবিতাগুলি যখন লিখি তখন উত্তর-আধুনিকতার একটা প্রভাব আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।(যদিও তার অর্থ এই নয় যে উত্তর-আধুনিতার উপর আমার আকর্ষণ এখন শেষ হয়ে গেছে। না, আমি এখনও এই ইজমের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল।) ফলে আমার মিরর এফেক্টের কবিতাগুলোতে উত্তর-আধুনিকতার বৈশিষ্ট কে ধরতে চেয়েছি। যদিও আমি জানিনা এ কাজে আমি কতটা সফল হতে পেরেছি। 
 এ পর্যন্ত আমার চারটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সেগুলি হলো—জুড়ন পুকুর/নক্ষত্রের গান/ব্যালেরিনা ও নকসি কাঁথায় নষ্ট গন্ধ/মিরর এফেক্ট।




৬/   কবিতা মানেই তো বন্ধনহীনতা। মনের মুক্তি, ভাবনার মুক্তি। তাহলে 'জিরো বাউন্ডারি'তে নতুন কী এমন বলা হল?

উত্তরঃ- অবশ্যই কবিতা মানেই বন্ধনহীনতা। এখন সেই বন্ধনহীনতাকে কবিতায় ঠিকঠাক প্রতিফলিত হতে হবে তো।  এই বন্ধনহীনতাকে কবিতাই ঠিকঠাক প্রতিফলিত করার জন্য বেশ কিছু বৈশিষ্টের কথা উল্লেখ করা হয়েছে জিরো কনসেপ্টে। এ যেন রোগীর রোগ সারানোর জন্য ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন। এই যে বাউণ্ডারি বা সীমাহীনতার কথা জিরো বলছে তার অর্থ কিন্তু মোটেই এই নয় যে ছুটতে ছুটতে কবিতা বিশাল অন্ধকার খাদের মধ্যে কবিতা গিয়ে পড়ুক। না তা নয় আসলে বাউণ্ডারিহীনতার মধ্যেই একটা অদৃশ্য বাউণ্ডারি লাইন কিন্তু টানা আছে। এর ভেতরেই কবিতার মুক্তাঞ্চলটি। এর ভেতরে থেকেই কবির কবিতাসৃষ্টির দক্ষতাটি লুকিয়ে।  মুক্তাঞ্চলটিকে ভুলবশত সীমাহীন ধরে নিলে একটা ক্যাওসের সৃষ্টি হবে কবিতায়, যেটা কিন্তু জিরোর উদ্দেশ্য নয়। অর্থাৎ এই সীমাহীনতার আর এক অর্থ হিসেবে যদি অসীমের কথা বলি তবে বলতে পারি এই অসীম কিন্তু অরুপের সন্ধ্যান নয় বরঞ্চ রূপকেই নতুন করে চিনতে শেখার কথাই বলে। অর্থাৎ কবিতাকে কিন্তু কবিতা হতে হবে। বাউণ্ডারিহীনতার কথা ভেবে উল্লসিত হয়ে এমন কিছু করা চলবে না যা কবিতায় একটা বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয় এবং অকবিতা লেখার দিকে কবিকে ঠেলে দেয়। অনেকের কাছে কথাটা প্যারাডক্সের মতো মনে হলেও এটাই কিন্তু জিরোর প্রথম শর্ত কবিতাকে কবিতা হয়ে উঠতে হবে।



৭/   আচ্ছা কুমারেশদা আপনার কী মনে হয়, 'জিরো বাউন্ডারি' কনসেপ্টের প্রবক্তা, নিরহংকার কবি-চিন্তাবিদ  আফজল আলি একজন বাঙালি বলেই কী কেউ কেউ এই তত্ত্বকে উন্মুক্ত হৃদয়ে মান্যতা দিতে চাইছেন না?

উত্তরঃ- এই প্রশ্নের উত্তরে আমি নন্দলাল বসুর একটা প্রবন্ধ “দৃষ্টি ও সৃষ্টি”-র কথা আনতে পারি। তিনি শিল্পকলার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন যে ভারতীয়রা কোনো কিছুকে মান্যতা দেবার ক্ষেত্রে বিদেশীদের উপরে নির্ভর করে থাকে। অর্থাৎ একটা চিত্রশিল্প তখনই বেশি মান্যতা পায় যখন বিদেশীরা তার প্রসংসা করে। এই জিরো কনসেপ্টটিই যদি বিদেশে কোনো কবির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হতো বা নিদেনপক্ষে কোনো কোনো বিদেশী(মূলত ইউরোপীয়ান) এই কনসেপ্টের প্রশংসা করে দুকলম লিখতেন তাহলে দেখতে আমরা হুমরি খেয়ে পড়তাম এই কনসেপ্টের উপর। আসলে চিন্তাগত দিক দিয়ে আমরা এখনও ইউরোপীয় প্রভাব থেকে কতটা মুক্ত হতে পেরেছি সে সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।



৮/   'জিরো বাউন্ডারি' এবং 'পোস্টমর্ডান' কোনটিকে কেমন ভাবে দেখছেন? আপনার কী মনে হয় 'পোস্টমডার্ন' উত্তর অবস্থানে 'জিরো বাউন্ডারি' সেই স্থান দখল করতে পারবে?

উত্তরঃ- পোস্ট-মর্ডানিজম কবিতার এক খণ্ডিত ইজম বা দর্শন।  এখানে ডিসেন্ট্রালাইজেশন (বিকেন্দ্র্রণ )-এর কথা বা আরও স্পষ্টভাবে বললে প্রান্তিকতার কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে জিরো পড়ে যেটুকু বুঝেছি তা হলো জিরো বাউণ্ডারি কনসেপ্ট বিভিন্ন ইজমকে বা দর্শনকে আত্মগত করে গড়ে ওঠা এক অখণ্ড দর্শনের  রূপ। এজন্যেই জিরো বাউণ্ডারি কনসেপ্ট বলা হচ্ছে। ইজম বলা হয় নি।  এখানে কবিতার বহুগামিতার কথা বলা হয়েছে। এজন্যই ছন্দের কবিতাকেও যেমন জিরো অস্বীকার করছে না তেমনই টানা গদ্যে লেখা কবিতাকেও। কবিতার বহুগামিতার কথা সেভাবে আগে কোনো ইজম বলেনি। যদিও বহুরৈখিকতার কথা বলা হয়েছে। আর শূন্যস্থান পূরণের যে কথা তুমি জানতে চেয়েছো তার উত্তর আমি আগেই দিয়েছি অন্য প্রশ্নের উত্তরে।



৯/   কুমারেশদা, আপনার কাছে আমরা জানতে চাইব, কবিতা সাহিত্যে 'শূন্যতত্ত্ব' একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। স্মরণাতীতকাল থেকেই এর চর্চা চলছে সমানতালে। অনেকে বলছেন 'জিরো' থেকে পাঠকের দৃষ্টি সরিয়ে দেওয়ার জন্যই 'শূন্য'কে আবার নতুন করে সামনে আনা হচ্ছে। এ সম্পর্কে  আপনি কী বলবেন?

উত্তরঃ- এক অদ্ভুত শূন্যতা বোধ করছি— আচ্ছা আমরা কেন এই রকমভাবে বলি। আমরা তো বলতে পারতাম—সব শূন্য হয়ে গেল। আসলে আমরা শূণন্যতাকে অনুভব কবি মাত্র। পূর্ণতা বা আংশিক পূর্ণ থেকে কিছু অংশ ফাঁকা হয়ে গেলে আমরা সেই অংশের জন্য একটা শূন্যতা অনুভব বা বোধ করি। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে শূন্যতা বলে আমরা যা ভাবি তা কোনো সংখ্যাগত শূন্যতা নয়। তা হলো আত্মগত শূণ্যতা যার রূপটি হলো বিমূর্ত। বাস্তবে এই শূন্যতা মন বা অত্মার উপরই বেশি ক্রিয়া করে। এমনকি শঙ্করাচার্যও বৌদ্ধদের শূণন্যতত্ত্বকে মানেন নি। শুতরাং শূন্যতত্ত্ব মানে সেই পূর্ণতারই সন্ধ্যান। আধ্যাত্মিক অর্থে এই শূণ্যতা এক সাধককে পূর্ণতা দেয় যা ঈশ্বরের সঙ্গে মহামিলনের পথকে সুগম করে। আবার এই যে মহাশূন্য তার বুকেই কিন্তু ঝুলে আছে আমাদের এই সৌরজগত সমেত অন্যান্য সৌরজগতগুলি। সেদিক দিয়ে দেখলে আমরা বুঝতে পারছি এই শূন্য কিন্তু প্রবলভাবে অস্তিত্বময়। আবার শূন্য মানেই তো যা নেই। উলটোভাবে ভাবলে যা নেই মানেই কিছু আছে। এই কিছুর সন্ধ্যান করায় তো শূন্যতত্ব। ঈশ্বর নিরাকার যদি ধরে নিই। তবে বলতেই যখন ঈশ্বরের কনসেপ্ট সেই সৃষ্টির শুরুর থেকে চলে আসছে তখন নিশ্চয় কিছু আছে। এই আছের সন্ধান করার ক্ষেত্রেই শূন্যের ভূমিকা। 
আমি এই কথাগুলি বললাম তোমার প্রশ্নের প্রতিধ্বনি করে এটা বোঝাতে যে শূন্যতত্ব নিয়ে কিন্তু বহু লেখালেখি হয়েছে। এখন হলো কি জিরো বাউণ্ডারির জিরোর শূন্যতত্বের এই শূন্যের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। বরঞ্চ বলা যায় এই শূন্যতত্বকে নিয়ে আসার অর্থ চর্বিতচর্বণ। যেখানে কিনা জিরো সম্পূর্ণ এক নতুর ভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত করছে। এখানে জিরো অর্থ সেই শূন্য যা অস্তিত্বময় এবং কবির সঙ্গে কবিতার মিলনের পথে একটা সেতুর কাজ করায় যেন তার মূল ইচ্ছে। সুতরাং আমি শূন্যতত্ত্বকে যদি কেউ পুনরায় নিয়ে আসতে চায় তবে তা আনতেই পারে কারণ জিরোর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।




১০/   কবিতায় এক্সপেরিমেন্ট, বিষয়টি একজন পাঠক কেমন ভাবে নেয় ? আপনার কী মনে হয়, 'এক্সপেরিমেন্ট' একটি কবিতা হয়ে-ওঠার ক্ষেত্রে কতখানি গুরুত্ব দাবি করে?

উত্তরঃ- এক্সপিরিমেন্টের কথা বললেই আমার চোখের সামনে একটা ল্যাবরেটরির দৃশ্য ভেসে ওঠে যেখানে একটা গিনিপিগের উপর কিছু পরীক্ষা করছেন কয়েকজন বিজ্ঞানী। আচ্ছা বলো কবিতা কি কোনো গিনিপিগ। অথবা বলো চর্যাপদ থেকে শুরু করেআজ পর্যন্ত পরীক্ষা কথাটা কি কেউ ব্যবহার করে গেছেন। নাকি তারা কবিতার কিছুই জানতেন না। শুধুই লিখে গেছেন পাতার পর পাতা। সুতরাং পরীক্ষা শব্দটিতে আমার তীব্র আপত্তি আছে। কবিতাকেযদি বিমূর্ত ধরা হয় তবে তার উপর পরীক্ষা করা যাবে। নাকি এর ল্যাবটিও বিমূর্ত। হ্যাঁ কবিতায় কিছু নতুন প্রয়োগ আনা যেতে পারে এবং অবশ্যই তা শব্দ দিয়ে। যেমন জিরো বলছে শব্দ ব্যবহারে একটা ফোর্স আনার কথা। মালার্মের কথা ধরলেও আমরা দেখি তিনি কবিতায় এই শব্দব্রহ্মের কথাই বলেছেন। তাই কবিতায় ইজম আসতে পারে কিন্তু কোনোভাবেই পরীক্ষা নয়।



১১/    বর্তমানে কবিদের কবিতা চর্চার পাশাপাশি হোয়াটস্ অ্যাপ গ্রুপ খুলে কবিতা পোস্ট, কবিতা পাঠ, তুমুল আড্ডার, একটা চল লক্ষ্য করা যাচ্ছে।যেমন আমাদের 'জিরো বাউন্ডারি' গ্রুপ। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?

উত্তরঃ- বর্তমানে আমরা যে দুনিয়ায় বাস করছি তাকে বলা হচ্ছে ভার্চুয়াল দুনিয়া। বিভিন্ন টেকনোলোজি আজ মানুষের আয়ত্বে। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ বা অন্যান্য সোস্যাল মিডিয়াও এই ভার্চুয়ালিটির অন্যতম উপকরণ। এগুলি আসার ফলে আমি সুদুর আন্দামানে থাকা আমার বন্ধুটির সঙ্গে কবিতা বিষয়ক যে কোনো মতামতের আদানপ্রদান করতে পারছি এবং সহজে। ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে তৎক্ষণাৎ আমরা জানতে পারছি অন্যের মতামত বা জানাতে পারছি নিজের চিন্তাভাবনা। 
এখন যেহেতু আমি নিজেও কয়েকটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত তাই আমি দেখেছি বেশ কিছু গ্রুপে কবিতা বা সাহিত্যের অন্যান্য বিষয় নিয়ে ভালো আলোচনা হতে। আমার অজানা কোনো বিষয় যা জানতে বা শিখতে আমাকে কোনো বইয়ের সাহায্য নিতে হতো, গ্রুপে থাকার ফলে অনেকটা যেন কথোপকথনের চালে আমি শিখে পারছি সেই অজানা বিষয় কে (যদিও এটাও ঠিক প্রিন্টেড বইয়ের কোনো বিকল্প হয় না। তার ফ্লেভারই আলাদা)। বিভিন্ন তর্ক-বিতর্ক থেকে উঠে আসা নির্জাস কে ধরে নিতে পারছি সহজেই।




১২/   যৌনতাধর্মী শব্দের বহুল ব্যবহার করে এই সময়ে কবিতা লেখার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তরুণ কবিদের মধ্যে। একদল আলোচক এগুলোকে কবিতা হিসাবে মানতে নারাজ। আপনার মতামত একটু জানতে চাইছি।

উত্তরঃ- আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যৌনতা আসলে আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যৌনতাকে এড়িয়ে জীবনের কথা ভাবা প্রায় অসম্ভব। আহার নিদ্রা এবং মৈথুন এই যে কথাটি এর মধ্যে মৈথুন শব্দটি এলো কেন। মৈথুন তো যৌনতারই আরেক রূপ। আসলে এই মৈথুন না থাকলে সৃষ্টিরও তো সম্ভাবনা ছিল না কারণ মানুষ সহ অন্য কোনো প্রাণীই তো আর সয়ম্ভু নয়। 
এই কথা শুনে হয়তো মনে হতেই পারে আমি কবিতায় যৌনতার পক্ষে। হ্যাঁ অবশ্যই পক্ষে তবে সেই যৌনতা কোনো উগ্র যৌনতা নয়। আমরা যে সভ্যতা-সংস্কৃতিতে জন্মগ্রহণ করে বড়ো হয়ে উঠি সেই সংস্কৃতির মধ্যে মাতৃক কথাটির একটা ছায়া যেন সর্বদায় লেগেলেপ্টে থাকে। আরও স্পষ্টভাবে বললে বলা যায় বা প্রশ্ন করা যায়—আমরা কি আমাদের প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে খাজুরাহের চিত্রকল্প দেখতে যেতে পারব? সাংখ্যধীক্যে উত্তর হবে—না। আমাদের সংস্কার বা সংস্কৃতি তার অনুমতি দেয় না। তাহলে কবিতাতেই বা কেন এত উগ্র যৌনতা আনতে হবে। আর হাংরি তো প্রমাণ উগ্র যৌনতাকে আমাদের সংস্কৃতি গ্রহণ করে নি। সুতরাং যৌনতা থাক ক্ষতি নেই তবে তার আড়াল থাক। কিছু ভালগার শব্দকে কবিতায় এনে যৌনতাকে ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস শেষ পর্যন্ত সফল হয় কি?



১৩/    আমরা জানি আপনার সম্পাদিত 'কায়াকবিতা'  পত্রিকাটি পাঠকের কাছে বিশেষ সমাদৃত। সম্পাদনার কাজে কতদিন ধরে যুক্ত?

উত্তরঃ- হ্যাঁ আমি কায়াকবিতা নামে একটা পত্রিকা বের আসছি গত ৬ বছর যাবৎ। তবে বর্তমানে সময়মতো পত্রিকা বের করার ক্ষেত্রে কিছু অসুবিধের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। প্রথমত আর্থিক সমস্যা। একটা ছোটোপত্রিকা চালাতে নিজের গাঁটের কড়ি খরচ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না কারণ ছোটোপত্রিকা সে অর্থে কোনো বিজ্ঞাপন পায় না। আর আমার যা চরিত্র তাতে অসুবিধে আরও বিশাল। আমার পক্ষে ইনিয়েবিনিয়ে বিজ্ঞাপন জোগাড় করা এক অসম্ভব ব্যাপার। 
দ্বিতীয়ত আমি এক্ষেত্রে খুব একা। সেই অর্থে কারও সঙ্গ পাইনি। আর এটা তো জানো একার পক্ষে পত্রিকা বের করা কতটা পরিশ্রমের কাজ। আমার নিজের লেখালেখিরও ক্ষতিগ্রস্থ হবার সম্ভাবনা থেকেই যায়। 
যাই হোক তবুও একটা প্যাশন থেকে পত্রিকার কাজ শুরু করেছিলাম। এখন ভবিষ্যতই বলবে 
কতদিন এভাবে পত্রিকার কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবো।



১৪/   কবিতা নিয়ে কোন তত্ত্ব লিখবেন?

উত্তরঃ- ওরে বাবা আমি আগেই বলেছি আবার বলছি আমি খুব অল্প জানা একজন মানুষ। কবিতার নতুন তত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে যে পোড়াশোনা তথা মেধার প্রয়োজন তা আমার নেই। তবে কেউ যদি (আফজল আলির মতো)নতুন কোনো তত্ব কবিতায় নিয়ে আসে এবং তার গ্রহণযোগ্যতা থাকে তবে তাকে অবশ্যই স্বাগত জানাবো। বাকি ভবিষ্যত বলবে।



১৫/   'জিরো বাউন্ডারি' কবিতা আন্দোলনে আপনি প্রথম থেকেই অগ্রনী ভূমিকা নিয়েছেন। একে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কীভাবে সম্ভব বলে আপনি মনে করেন?

উত্তরঃ- যে কোনো জিনিসের সঠিক প্রেজেন্টেশন তার গ্রহণযোগ্যতার পথকে সুগম করে। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি ধরো এক ভাস্কর একটা ভাস্কর্য নির্মাণ করে অবহেলায় ফেলে রাখলেন। তাহলে সেই ভাস্কর্যের কথা কি মানুষ আদৌ জানতে পারবে। সেক্ষেত্রে শিল্পির উচিৎ কাজ তার সৃষ্টিকে মানুষের দরবারে পৌঁছে দেওয়া। আরও আরও মানুষকে তার শিল্পকর্মটিতে ইনভলব করা। তবেই তো শিল্পি ও শিল্পের উদ্দেশ্য সফল হবে। 
জিরো কনসেপ্টের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আফজল আলি এই কনসেপ্টকে প্রতিষ্ঠা করলেন তার মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে। এখন এই কনসেপ্টকে কবি-পাঠকের কাছে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব আমাদেরকেই নিতে হবে। আরও কবি-পাঠককে যুক্ত করতে হবে এই তত্বের সঙ্গে। এর গ্রহনযোগ্যতার কথা বিভিন্নভাবে তুলে ধরতে হবে কবি-পাঠকদের কাছে। কাজটা খুব কঠিন নয় শুধু দরকার একটু সত প্রয়াসের।



১৬/   যাঁরা নতুন লিখতে আসছেন তাদের জন্য কিছু বলুন।

উত্তরঃ-  সরি মাপ করো আমি নিজেকে এত বড়ো ভাবতে পারছিনা যে অন্যকে উপদেশ দেবো। আমি নিজেও কবিতার একজন ছাত্র। প্রতিনিয়ত শিখে চলেছি। তবু তুমি যেহেতু বললে তাই একটায় কথা বলবো যারা নতুন লিখতে এসেছে তারা যেন নিজের প্রতি ও কবিতার প্রতি সৎ থাকে কারণ আর যায় হোক উপরচালাকি দিয়ে কবিতার সাম্রাজ্যে টিকে থাকা যায় না। অন্য কেউ নয় কবিতায় একদিন হয়তো ছুড়ে ফেলে দেয় অসৎ কবিকে।








No comments:

Post a Comment